Blog

ঘুরে আসুন রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি

কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহের “কুঠিবাড়ি”। লাল ইটের তৈরি দ্বিতলা ভবন, বাগানবেষ্টিত মনোরম পরিবেশে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি হলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান।

এই কুঠিবাড়ি থেকেই রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যচর্চা, কবিতা, গান ও চিঠিপত্রের একটি বিশাল অংশ রচনা করেন।

শিলাইদহের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শান্ত পরিবেশ রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এখানেই তিনি লিখেছেন গীতাঞ্জলি, চিত্রা, সোনার তরী, খেয়াসহ আরও অনেক কাব্যগ্রন্থ।


শিলাইদহের কুঠিবাড়ি শুধু একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নয়, এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিশীলতার এক মহামূল্যবান নিদর্শন। এটি আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আজও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।


বর্তমানে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি একটি পর্যটনকেন্দ্র ও জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, পোশাক, পাণ্ডুলিপি, ছবি এবং অন্যান্য নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত খাট, নিজ হাতে আঁকা ছবি, তার ব্যবহৃত পালকি, হাত পালকি এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র রয়েছে এই বাড়িটিতে।



জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব-পুরুষদের বংশ পদবি ছিল ‘কুশারী’। তারা ছিলেন ‘পিরালী’ ব্রাহ্মণ (পতিত ব্রাহ্মণ)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কুশারী বংশের ১৩তম প্রজন্ম। মূলত জমিদারি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ঠাকুর পরিবারের দ্বারা ব্যবহৃত হতো। ঠাকুর পরিবারের পূর্বপুরুষ দ্বারকানাথ ঠাকুর এটি অধিগ্রহণ করেছিলেন, এবং পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদারি দেখাশোনা করতে আসতেন। এটি ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ব্যবস্থার কেন্দ্র ছিল।


কুষ্টিয়ার পদ্মার বুকে বজ্র ডিঙিতে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের সুখ-দুঃখ দেখে বেড়াতেন কবি। কালের বিবর্তনে জমিদারি প্রথা হারিয়ে গেলেও রয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি। কবির ব্যবহৃত সেই বজ্র ডিঙিটি নষ্ট হয়ে গেছে, তবে তার প্রতীকী নৌকা রয়েছে ঠাকুরবাড়িতে।


বাড়ির আঙিনায় লাগানো গাছগুলো প্রায় বৃদ্ধ হয়ে গেছে। তবে বিভিন্ন দেশ-বিদেশ থেকে আগত দর্শনার্থীরা এখনও এসে সেইসব গাছের নিচে বসেন এবং স্মরণ করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে কুঠিবাড়িটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা প্রতিনিয়ত ভিড় করে এখানে। এছাড়া রবীন্দ্র প্রেমীদের রবীন্দ্র সংগীত শোনার ব্যবস্থাও রয়েছে কুঠিবাড়ীর আঙিনায় দিঘির পাড়ে।


কুষ্টিয়ার কুঠিবাড়িতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা জানান, শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে ঘুরতে এলে মনোরম পরিবেশের কারণে মন ভালো হয়ে যায়। এছাড়া এখানে এলে বিশ্বকবি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়, তার সাহিত্যকর্ম, গান ও ইতিহাস জানা যায়। তার সময়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে ইতিহাস জানা যায়।


দর্শনার্থী মহিমা পারভীন জানান, কুঠিবাড়িতে এলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনযাপন সম্পর্কে জানা যায়। তার ইতিহাস বইতে পড়ার পরে এখানে এসে নিজের চোখে তার ব্যবহারের জিনিসপত্র, সাহিত্যকর্ম দেখলে মনে হয় এখনো জীবন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


তিনি আরও বলেন, আমার খুবই ভালো লাগে এখানে আসতে। তাই বারবার ছুটে আসি। কুঠিবাড়ির আঙিনার সবখানেই মনে হয় বিশ্বকবির ছোঁয়া/স্পর্শ রয়েছে। তার স্মৃতিতে ঘেরা এই বাড়িটি।


শেফালী খাতুন জানান, এখানে আমরা প্রায়ই আসি। আজকে সপরিবারে এখানে নাতি-নাতনি নিয়ে ঘুরতে এসেছি। খুবই ভালো লাগছে। অনেক কিছু দেখেছি, বাচ্চারাও খুব আনন্দ করছে।


রাজিয়া সুলতানা জানান, কুষ্টিয়ায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি থাকায় আমরা কুষ্টিয়ার মানুষ গর্ববোধ করি।


যারা কুঠিবাড়িতে ঘুরতে আসেন তাদের বেশিরভাগ দর্শনার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বিশ্বকবির বাড়ি, ব্যবহারের জিনিসপত্র এবং দিঘি। দিঘির পাড়ে গেলেই মন কেড়ে নেয় রানু বিশ্বাসের রবীন্দ্র সঙ্গীতের আসর। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে দর্শনার্থীদের রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনাচ্ছেন। তার গান শুনে মুগ্ধ হয় দর্শনার্থীরা।


রানু বিশ্বাস বলেন, এখানে প্রায় ২০ বছর ধরে এই পুকুর পাড়ে গাছের নিচে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গাই। সাধারণ ও ভিআইপি দর্শনার্থী এবং বিদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতদের গান শুনিয়েছি আমি।


তিনি জানান, এখানে কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে নানা আয়োজন করা হলেও মৃত্যু দিনটাতে তেমন কোনো আয়োজন থাকে না। মৃত্যু দিনটা ঘরোয়া পরিবেশে হয়। জন্মদিনের মতো মৃত্যুদিনেও আয়োজনের দাবি জানান তিনি।


প্রতি বছর ২৫শে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কুঠিবাড়িতে আয়োজিত হয় রবীন্দ্রমেলা। দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী ও সাহিত্যপ্রেমীরা এখানে সমবেত হন। নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন, আলোচনা, গান, নাটক ও আবৃত্তির মাধ্যমে এই স্থান প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।


কুঠিবাড়িতে আগত দর্শনার্থীদের জন্য সরকারিভাবে নিরাপত্তা ও খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে, তবে দর্শনার্থীদের ভালো খাবারের ব্যবস্থা নেই বলে জানান কুঠিবাড়ির কাস্টডিয়ান আল আমিন।


তিনি জানান, আসছে ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও জমকালো আয়োজনের মধ্যদিয়ে উদযাপন করা হবে। এবারে নতুন কিছু বিশেষ আয়োজন থাকবে। আসছে ২৫শে বৈশাখে সবাই ভিন্নরূপের কুঠিবাড়ি দেখবে এমনটাই আশা করেন তিনি।


সাহিত্যচর্চার এক নিঃশব্দ সহচর হয়ে আজও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে প্রকৃতি ও সাধারণ জীবন এক মহান শিল্পীর কল্পনাকে জাগ্রত করতে পারে। এটি আমাদের জাতিসত্বার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য রত্ন।


বাংলাদেশ সময়: ০৯১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২৫


আরএ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button